সেনাবাহিনীর উর্দির নিচে গণতন্ত্রের বেশ ধরে ৭৫ বছর ধরে শাসন চলছে পাকিস্তানে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো সরকার সংবিধান নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। কোনো না কোনো কারণে সরে যেতে হয়েছে। সর্বশেষ গতবছরের এপ্রিলে দেশটির পার্লামেন্টে জাতীয় পরিষদের অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান।
এর পর থেকে সেনাবাহিনী ও সরকারের সঙ্গে নানা ইস্যুতে ইমরান খানের দ্বন্দ্বে পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে এসছে যে, ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পাকিস্তানের বর্তমান সংকটা কী?
গত ৯ মে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই নেতা ইমরান খানকে ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হন। ইমরান খান আল-কাদির ট্রাস্ট মামলায় জামিন নিতে গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর বিক্ষোভের ডাক দেন পিটিআই’র শীর্ষ নেতারা। গ্রেপ্তারের পরপরই লাহোরে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয় পিটিআই সমর্থকরা। ক্ষুব্ধ সমর্থকেরা লাহোরে শীর্ষ এক সেনা কর্মকর্তার বাসভবনেও আগুন দেয়। উত্তাল হয়ে উঠে পাকিস্তান। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়। টুইটার, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারও বন্ধ করা হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে পিটিআই সমর্থকরা। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়ি, চেকপোস্ট, আধাসামরিক বাহিনীর চেকপোস্ট, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, সরকারি রেডিও ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুন দেয়। পেশোয়ার, পাঞ্জাব, লাহোর, করাচি, ইসলামাবাদসহ বড় বড় শহরগুলোতে জোরালো বিক্ষোভ হয়। কয়েকটি প্রদেশে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। বিক্ষোভের মুখে ইমরান খানকে জামিন দিতে বাধ্য হন আদালত। তবে সহিংসতার অভিযোগ এনে ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করা হয় সেনাবাহিনী ও সরকারের পক্ষ থেকে। অভিযান চালানো হয় ইমরান খানের বাসায়। তার দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় হেনস্থা করা হয় ইমরান খানকে। যদিও ২৩ মে ৮ মামলায় ইমরান খানকে জামিন দেন আদালত।
পাকিস্তানে যেসব দল নিষিদ্ধ হয়
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ৭৫ বছর পার করেছে পাকিস্তান। এই সময়ের মধ্যে দেশটির অন্তত ৫টি দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তান। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাতের অভিযোগে ১৯৫৪ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার। ১৯৭১ সালে নিষিদ্ধ করা হয় আওয়ামী লীগকে। দলটির বিরুদ্ধে সরকারকে অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়। ১৯৬৭ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ভেঙে যায়। এক পক্ষের নেতৃত্ব দেন আবদুল ওয়ালি খান। আবদুল ওয়ালি খান ন্যাপের একাংশের দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই দফায় দলটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার। ২০২০ সালে নিষিদ্ধ করা হয় জয় সিন্ধ কওমি মাহাজ-আরিসারকে। দলটির বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন দ্য সিন্ধুদেশ লিবারেশন আর্মি ও সিন্ধুদেশ রেভল্যুশন আর্মির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে নিষিদ্ধ করা হয় তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানকে। এখন সহিংসতার অভিযোগে তেহরিক-ই-ইনসাফকেও নিষিদ্ধের পাঁয়তারা চলছে।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের দ্বন্দ্বটা কী?
২০১৮ সালে ইমরান খান মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় আসে। তবে সেই সুসম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি। পাকিস্তানে বর্তমানে সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুজন ব্যক্তি হলেন সেনাপ্রধান আসিম মুনির এবং আইএসআই-এর ডিজি জেনারেল ফয়সাল নাসের। জেনারেল মুনির আগে এসআই-এর প্রধান ছিলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে তার সমস্যা শুরু হয়। মুনিরের দাবি, তিনি ইমরান ও তার ক্যাবিনেটের লোকদের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে তদন্ত করতে গেলে ইমরান রাগান্বিত হয়েছিলেন। মনে করেছিলেন, এরা তাদের এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক শক্তিকে অবমাননা করছেন। ইমরানের অহং ও আত্মসম্মানবোধের জন্য তা ছিল অগ্রহণযোগ্য। ইমরান, জেনারেল মুনিরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই তাকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তখনই সেনা ও ইমরানের মধ্যে টানাপড়েনের বিষয়টা জনসম্মুখে আসে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া, আসিম মুনিরের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মানতে রাজি ছিলেন না। শেষে ‘নো কনফিডেন্স’ ভোটে ইমরানকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। জেনারেল বাজওয়া অবসরে যাওয়ার সময় শাহবাজ শরিফের সরকারকে দিয়ে ইমরানের শত্রু জেনারেল আসিম মুনিরকে সেনাপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত করে যান।
ইমরানের জনপ্রিয়তা
পাকিস্তানে এমনটা বহুবার দেখা গেছে সেনাপ্রধানের সাহায্য নিয়ে রাজনৈতিক শাসকরা আসেন। সেনাপ্রধানরা সরাসরি রাজত্ব না করলেও রাজনৈতিক শাসককে পুতুল বানিয়ে সেনারাই সরকার চালায়। তারপর সেনাদের সঙ্গে আবার ঝগড়া হয় এবং সেনারা হয় সেই রাজনৈতিক শাসককে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়, নয়তো গ্রেপ্তার করে। এভাবে বহু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শাসক বলি হয়েছেন। ইমরান খানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হতে চলেছে। নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে পারভেজ মোশাররফকে বসিয়েছিল সেনাবাহিনী। পারভেজ মোশাররফ একজন সেনাপ্রধান হয়েও সেনাবাহিনীর দ্বারা দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন।
তবে ইমরান খানের বিষয়টি নওয়াজ শরিফ বা পারভেজ মোশাররফের মতো নয়। একজন সুপারস্টার ক্রিকেটার থেকে তিনি রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, তাই ইমরানের বিরুদ্ধে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে হলে সেনাবাহিনীকে বহুবার ভাবতে হবে। তিনি যে পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার প্রতি অবিচার হচ্ছে বলে তার সমর্থকরা সেনা সদর থেকে শুরু করে কোর কমান্ডারের বাড়িতে পর্যন্ত আগুন দিয়েছে। পাকিস্তানের ইতিহাসে এটা এক অনন্য নজির।
ইমরানের পাশে সোশ্যাল মিডিয়া
সেনাবাহিনী মূলত আইএসপিআর মিডিয়া গ্রুপ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবাদ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ করে পাকিস্তানে একটি আধা-গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে চায়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষপটে সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আর তথ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সেনাবাহিনী। ইমরান সমর্থকরা ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে ইমরানের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। ফলে ইতোপূর্বে যে কোনো সরকারকে দমন করা যতটা সহজ ছিল ইমরানের ক্ষেত্রে মোটেই তেমনটা হবে না।
ক্ষমতার তিন বলয়
পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে দেশটির সেনাবাহিনী, সুপ্রিম কোর্ট ও রাজনীতিবিদরা। এরইমধ্যে নিজের দলের বাইরে বিরোধী দলের রাজনীতিকদের বিরাগভাজন হয়েছেন ইমরান খান। সেনাবাহিনীর সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো নয়। এই দুই শক্তি চায় ইমরান ও তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফকে রাজনীতি থেকে বিতাড়িত করতে। তবে মঙ্গলবার দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খানকে ৮ মামলায় জামিন দেন। জামিন দেওয়া হয় তার স্ত্রীকেও। এতে করে আপেক্ষিকভাবে ইমরান খানের প্রতি সুদৃষ্টি লক্ষ করা যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের। তবে সেটা কতদূর প্রলম্বিত হবে তা সময়ই বলে দেবে।
সারকথা
সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানের যেকোনো সরকারের দ্বন্দ্বে সরকারকে শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে দেখা গেছে। এমনকি সব সরকারই সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত মেনে বা আতাত করে চলেছে। কিন্তু ইমরান খান সেনা সমর্থনে ক্ষমতায় এলেও ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি আর সেটা করেননি। তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পেছনে এটাই কারণ বলে মনে করা হয়। তবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও থেমে যায়নি তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ। দলের নেতাকর্মীরা ইমরান খানের পাশে রয়েছে খুবই শক্তভাবে। ইমরানের ওপর যেকোনো আক্রমণে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে সর্বস্ব দিয়ে। এমনটি এর আগে অন্য কোনো সরকারের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। পাকিস্তানকে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেওয়া এই নেতার জনপ্রিয়তা নজিরবিহীন। ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জয় এবং ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ গঠনের পর থেকে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া ইমরান খানকে সহজে যে সরানো যাবে না তা বুঝতে বাকি থাকে না।
একদিকে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সেনাসমর্থিত আধাগণতান্ত্রিক সরকারের দমনপীড়ন, অন্যদিকে জনসমর্থিত ইমরান খানের গণতন্ত্রের লড়াই। ৭৫ বছরের সেনা উর্দি থেকে বের করে ইমরান খান কি পাকিস্তানে একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে, নাকি সেনাবাহিনীর কূটকৌশলে আগের সব শাসকের মতো ইমরান খান ও তার দল কালেরগর্ভে হারিয়ে যাবে সেদিকে দৃষ্টি দেশটির জনগণের।

-নিউজ টোয়েন্টিফোরের বিশ্লেষণ